শরিফ ওসমান হাদি—তিনি শুধু একটি নাম নন, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক প্রতীক।
নির্ভীক কণ্ঠে সত্য উচ্চারণ, ফ্যাসিবাদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর সাহস এবং ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সংগ্রামী চেতনার নাম।
জুলাই বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতে যখন আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা মানুষের বিবেককে গ্রাস করেছিল, তখন হাদি ছিলেন দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
মঞ্চে কিংবা মাইক্রোফোনের সামনে তার কণ্ঠে ছিল না কোনো দ্বিধা, দৃষ্টিতে ছিল না ভয় বা সংশয়। তিনি বিশ্বাস করতেন—সত্য বলার ঝুঁকি থাকলেও নীরব থাকার দায় আরও ভয়াবহ। আধিপত্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে অবিচল থেকে তিনি লালন করেছিলেন ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।
কিন্তু সেই বজ্রকণ্ঠকে থামিয়ে দেয় আততায়ীদের গুলি। গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্সকালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা চলন্ত রিকশায় থাকা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। টানা আট দিনের লড়াই শেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশজুড়ে। মুহূর্তেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
শরিফ ওসমান হাদি, যিনি ওসমান হাদি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, জন্মগ্রহণ করেন ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হাদি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। পাশাপাশি একটি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোচিং সেন্টারেও পাঠদান করতেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন।
ঝালকাঠির এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে রাজধানীতে আসেন হাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না।
তবে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান তাকে সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে নিয়ে আসে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ওসমান হাদি ছিলেন সামনের সারির এক সাহসী যোদ্ধা।
তিনি রাজধানীর রামপুরা এলাকায় আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জুলাই শহীদদের অধিকার আদায়, আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং ‘ন্যাশনাল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ইউনিটি’র ব্যানারে রাজপথে তিনি ছিলেন সদা সক্রিয়।
ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল এমন এক বাংলাদেশ—যেখানে থাকবে ইনসাফ, থাকবে ন্যায়বিচার, থাকবে মানুষের মর্যাদা। তার কণ্ঠ থেমে গেলেও সেই স্বপ্ন এখনো বহু মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছে।
এসআর
মন্তব্য করুন: