[email protected] রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
১৩ পৌষ ১৪৩২

জাহাজভাঙা শিল্প

দুর্ঘটনার ভারে বিপন্ন শ্রমিকদের জীবন, প্রশ্নের মুখে ‘গ্রিন ইয়ার্ড’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ৪:৩৫ পিএম

বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নানা ঘোষণা ও নীতিমালার পরও শ্রমিকদের

 জীবন এখনো বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এই খাতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর বড় একটি অংশ আগেভাগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর—এই এক বছরে জাহাজভাঙা শিল্পে অন্তত ৪৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মোট ৫৮ জন শ্রমিক আহত বা নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, ৩১ জন গুরুতর আহত এবং ১৫ জন তুলনামূলকভাবে হালকা আঘাত পেয়েছেন। কয়েকটি ঘটনায় একাধিক শ্রমিক একসঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার হন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) পরিচালিত এই গবেষণায় শ্রমিকদের সরাসরি তথ্য, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দুর্ঘটনার ধরন, সময়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, পেশাভিত্তিক ঝুঁকি এবং চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, দিনের বেলায় দুর্ঘটনার হার তুলনামূলক বেশি হলেও রাতের কাজও সমান ঝুঁকিপূর্ণ। পর্যাপ্ত আলো, তদারকি ও বিশ্রামের অভাব রাতের দুর্ঘটনাকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। বিশেষ করে ভারী লোহা কাটা, লোডিং এবং জাহাজের কাঠামো ভাঙার সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
আহতের ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনাই মারাত্মক। হাত-পা বিচ্ছিন্ন হওয়া, হাড় ভাঙা, মাথা ও বুকে আঘাত, কিংবা আগুন ও বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়ার মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারী লোহার আঘাত, উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়া এবং ট্যাংকের ভেতরে দুর্ঘটনা—যেগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে এড়ানো সম্ভব ছিল।
পেশাভিত্তিক হিসাবে কাটারম্যান, কাটার হেলপার, ফিটার এবং ওয়্যার গ্রুপের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। শরীরের যে অংশে বেশি আঘাত লাগে, তার মধ্যে পা ও হাতের ক্ষতি সর্বাধিক।
দুর্ঘটনার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষিত শ্রমিকের সংকট, গ্যাস ও অক্সিজেন লাইনের ত্রুটি এবং নিরাপত্তা বিধি মানার অনীহা। বর্ষা মৌসুম ও কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ে।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম। আইন অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যয় ও মজুরিসহ ছুটির বিধান থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ শ্রমিক তা পান না। ফলে অনেক পরিবার দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ও সামাজিক সংকটে পড়ে।
সরকারের ‘গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড’ উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, অবকাঠামো উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। কার্যকর নজরদারি, নিয়মিত নিরাপত্তা অডিট এবং শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গবেষণায় লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ, রাতের কাজ সীমিত করা, শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থা, ন্যূনতম মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজভাঙা শিল্প টেকসই করতে হলে সবার আগে শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর