বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়িত দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প যমুনা রেলসেতু নির্মাণে সরকারি অর্থ ব্যয়ে ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
রেলওয়ের অডিট শাখা, বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর (ফ্যাপাড) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক অডিট প্রতিবেদন ও নথিতে দেখা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে অস্বচ্ছতা, উচ্চ দর নির্ধারণ ও ভুয়া বিলের মাধ্যমে কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।
এসব অনিয়মের বড় অংশের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এবং রেলের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমানের বিরুদ্ধে। মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীদের আপত্তি উপেক্ষা করে তার দেওয়া একের পর এক ‘নোট অব অ্যাপ্রুভাল’-এর মাধ্যমেই বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) অর্থায়নে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর ওপর পৃথক ডাবল লাইনের এই রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। চলতি বছরের ১৮ মার্চ সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের পুরো প্রক্রিয়াজুড়ে অনিয়মের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ফ্যাপাডের ২০২০-২১ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ওই এক অর্থবছরেই প্রায় ৭০৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় অডিট আপত্তির মুখে পড়ে। ডিটেইল মেজারমেন্ট শিট, ড্রয়িং ও বিওকিউ ছাড়াই ১২৭ কোটি টাকার বেশি বিল পরিশোধ, যথাযথ ভাউচার ছাড়া সিডি-ভ্যাট বাবদ ৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ এবং কাজে ব্যবহার না হওয়া স্টিল পাইপ শিট পাইলের বিপরীতে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ের মতো গুরুতর অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।
এ ছাড়া কাজ বিলম্বিত হলেও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ডিলে ড্যামেজ আরোপ না করায় প্রায় ৯৯ কোটি টাকার সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে। ঠিকাদারের বিল থেকে আয়কর ও ভ্যাট না কাটায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
ইয়েনে লেনদেন ও অস্বাভাবিক দর নির্ধারণ
অডিট প্রতিবেদনে জাপানি মুদ্রা ইয়েনে হওয়া লেনদেন নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মোবিলাইজেশন ও ডিমোবিলাইজেশন খাতে ৪ হাজার ১৫২ কোটি ইয়েন ব্যয়কে ‘বিশেষ পর্যবেক্ষণ’-এর আওতায় আনা হয়েছে। ফ্যাপাড বলছে, প্রকল্পে চুক্তির শর্ত ও সরকারি বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বিশেষ ফিন্যান্সিয়াল ইন্সপেকশন (এসএফআই) প্রতিবেদনে আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। বিদেশি যন্ত্রপাতি চুক্তিতে নির্ধারিত দেশ থেকে না এনেই ৪০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে সিডি-ভ্যাট আদায়ের নামে আরও ৪৩০ কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
দর নির্ধারণের ক্ষেত্রেও চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বিভিন্ন প্যাকেজে অস্বাভাবিক উচ্চ দর অনুমোদনের ফলে সরকারকে অতিরিক্ত ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। সাইট সুবিধা ও ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণে সরকারি সিডিউলের তুলনায় অতিরিক্ত ১১৩ কোটি টাকা এবং আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে মূল্য সমন্বয়ের কারণে আরও প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
‘ম্যাজিক নোটে’ উচ্চ দর অনুমোদন
অডিট নথিতে দেখা যায়, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের কনসোর্টিয়ামকে দেওয়া ডব্লিউডি-১, ডব্লিউডি-২সহ বড় প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীরা তুলনামূলক কম দর বা কাজ পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান তার হাতে লেখা নোটে বারবার উচ্চ দর বজায় রাখার পক্ষে মত দেন।
তার নোটে উল্লেখ ছিল—
‘প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত কাজ শেষ করা জরুরি’,
‘দর কমালে কাজের মান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে’,
‘ঠিকাদারকে বারবার দর কমাতে বললে প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হবে’।
অডিটরদের মতে, এসব নোট কার্যত উচ্চ দর অনুমোদনের ‘ম্যাজিক পাস’ হিসেবে কাজ করেছে।
দুদকের তদন্ত ও নথি তলব
এ ঘটনায় গত ৪ আগস্ট দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে প্রকল্পের মূল ও সংশোধিত ডিপিপি, দরপত্র নথি, চুক্তিপত্র, বিল-ভাউচার, কাজের পরিমাপ খাতা এবং সভার কার্যবিবরণীসহ সব গুরুত্বপূর্ণ নথি তলব করা হয়েছে। দুদক সতর্ক করেছে—এ ধরনের অনিয়ম প্রমাণিত হলে উন্নয়ন সহযোগী জাইকার সঙ্গে ভবিষ্যৎ অর্থায়নও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. ইমরান আকন বলেন, “প্রাথমিক তদন্ত চলছে। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।”
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য মেলেনি
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন ফোন রিসিভ করেননি। প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমানের সঙ্গেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এসআর
মন্তব্য করুন: