বিশ্বের যে কোনো দেশের ইমিগ্রেশন একটি রাষ্ট্রের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়।
ভ্রমণকারী সেই দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই কিংবা দেশ ছাড়ার সময় ইমিগ্রেশন থেকেই ধারণা পেয়ে যায়—রাষ্ট্রটি কতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ, কতটা আধুনিক এবং নাগরিক ও অতিথিদের প্রতি কতটা সম্মানশীল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।বাংলাদেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন যেন কোনোভাবেই একটি স্বাভাবিক ভ্রমণ ব্যবস্থার অংশ নয়। বরং এটি এক ধরনের সন্দেহভিত্তিক জেরা কেন্দ্র, যেখানে বিদেশে যাওয়া মানেই অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আপনি ভ্রমণে যান, কাজের উদ্দেশ্যে যান কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলন বা সেমিনারে অংশ নিতে যান—ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি হলেই আপনার মনে হবে, আপনি বুঝি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত সেমিনার, সম্মেলন ও কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে। এসব আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণপত্র বা অনুমতিপত্র কোনো সাধারণ বিষয় নয়। পেশাগত পরিচয়, কাজের অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা ঝুঁকি—দেশে ও দেশের বাইরে বহুস্তরীয় যাচাই-বাছাইয়ের পরই এসব অনুমতি দেওয়া হয়।

বিশেষ করে সাংবাদিকরা প্রায়শই নিজ খরচে কিংবা নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ে এসব আন্তর্জাতিক আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। জাতিসংঘের মতো একটি বৈশ্বিক সংস্থা যখন কাউকে আমন্ত্রণ জানায়, তখন সেটি সেই ব্যক্তির পেশাগত স্বীকৃতিরই প্রতিফলন।
কিন্তু সেই সম্মানজনক আমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়েই ঢাকার বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে শুরু হয় ভিন্ন এক বাস্তবতা।
প্রথমেই শুরু হয় অপ্রাসঙ্গিক ও অবমাননাকর প্রশ্ন—কেন যাচ্ছেন? কিভাবে যাচ্ছেন? আপনাকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হলো? আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমরা জানি না—তাহলে ডাকলো কেন?
এসব প্রশ্নের সঙ্গে যাত্রার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রশ্নের ভাষা ও ভঙ্গিতে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিরক্তি। একজন যাত্রী তখন নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেন—যেন বিদেশে যাওয়াটাই একটি গুরুতর অপরাধ।

এর ওপর যুক্ত হয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। ইমিগ্রেশন বুথে কিছুক্ষণ পরপরই বন্ধ হয়ে যায় সার্ভার। সার্ভার নেই—মানে পুরো কার্যক্রম স্থবির। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ, লাইনে জমে ওঠে অস্থিরতা ও হতাশা। আবার সার্ভার চালু হলে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজ বুথে নেই। কেউ বলে—“অফিসার আসছেন”, কেউ বলে—“স্যারের অনুমতি লাগবে।”
এ যেন এক হিরক রাজার দেশ—যেখানে নিয়ম আছে, কিন্তু নিয়ম মানার কেউ নেই; দায়িত্ব আছে, কিন্তু দায়িত্বশীলতা নেই।
অথচ একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল স্থান হলো সেই দেশের ইমিগ্রেশন। এই ইমিগ্রেশনে যদি নিয়মিত সার্ভার না থাকে, যদি আধুনিক প্রযুক্তি না থাকে, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়—রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কোথায়? এমন পরিস্থিতিতে বড় কোনো অপরাধী বা আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সদস্য অনায়াসেই কি পার পেয়ে যেতে পারে না?
ডকুমেন্ট যাচাই প্রক্রিয়াও একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো অনলাইন বা ডিজিটাল যাচাই ছাড়াই কাগজপত্র দীর্ঘ সময় চোখে দেখে রাখা হয়। এরপর হঠাৎ করেই বলা হয়—“সব ঠিক আছে।” কীভাবে ঠিক আছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার চরম অভাব।

অনেক ক্ষেত্রে এই হয়রানি ও অব্যবস্থাপনায় এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। এর মধ্যেই বিমানের বোর্ডিং টাইম ঘনিয়ে আসে। যাত্রীকে দৌড়ে বিমানে উঠতে হয়—মানসিক চাপ, অপমান ও আতঙ্ক নিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ।
যদি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার আমন্ত্রণে যাওয়া সাংবাদিকদের এমন অভিজ্ঞতা হয়, তাহলে সাধারণ যাত্রীদের অবস্থা কেমন—তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়।
প্রশ্ন থেকে যায়— বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কি সত্যিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, নাকি কেবল অব্যবস্থাপনা, অহেতুক জেরা আর ক্ষমতার অপব্যবহার টিকিয়ে রেখেছে?
বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে ইমিগ্রেশন একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র, সেখানে বাংলাদেশে তা যেন একটি রিমান্ড হোম। কোনো অপরাধ না করেও যাত্রী নিজেকে অপরাধী ভাবতে বাধ্য হন—এটাই আজ বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার নির্মম ও বিব্রতকর বাস্তবতা।
এই অবস্থার সঙ্গে আরও একটি গুরুতর বিষয় যুক্ত হয়েছে—অপেশাদার ও প্রশিক্ষণবিহীন জনবল। ইমিগ্রেশনে দায়িত্ব পালনকারী অনেক কর্মকর্তারই নেই আন্তর্জাতিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলার ন্যূনতম শিষ্টাচার, নেই প্রটোকল জ্ঞান, নেই আন্তর্জাতিক মানের আচরণবিধি সম্পর্কে ধারণা। কীভাবে একজন বিদেশগামী বা বিদেশফেরত যাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হয়, কীভাবে সম্মান বজায় রেখে কাজ সম্পন্ন করতে হয়—সে বিষয়ে স্পষ্ট অজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়।
ফলে পুরো ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা যেন পরিণত হয়েছে এক আনকোরা, অনভিজ্ঞ ও অপ্রস্তুত জনবলে ভরা কাঠামোতে—যেখানে পেশাদারিত্বের বদলে ক্ষমতার প্রদর্শনই মুখ্য হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক মানের একটি ইমিগ্রেশন ব্যবস্থায় যেখানে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও সৌজন্য থাকার কথা, সেখানে বাংলাদেশে তা এখনো রয়ে গেছে অদক্ষতা, বিশৃঙ্খলা ও আচরণগত সংকটের এক দৃষ্টান্ত।
এসআর
মন্তব্য করুন: